আ ন ম আমিনুর রহমান
কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের (বশেমুরকৃবি) মাঠে হাঁটার সময় দেখি, ছোট্ট একটি পাখি মুখে পোকা নিয়ে নামছে। পাখিটি মাটি থেকে যখন ইঞ্চি ছয়েক ওপরে, ঠিক তখন কোত্থেকে একটি ফিঙে এসে আক্রমণ করল তাকে। উদ্দেশ্য, পোকাটি ছিনিয়ে নেওয়া।
ছোট্ট পাখিটি প্রাণপণে উড়াল দিল, পেছন পেছন ফিঙেও। দু-একটা ঠোকরও বসিয়ে দিল, কিন্তু পোকাটি ছিনিয়ে নিতে পারল না। দাঁড়িয়ে দেখছি সেই চমৎকার দৃশ্য। মিনিট দুই-তিন ধাওয়ার পর হঠাৎ পাখিটি মাটিতে নেমে দৌড়ে পাশের ছোট্ট ঝোপালো গাছের তলায় লুকাল। ফিঙে অনেক চেষ্টা করেও সেখানে ঢুকতে পারল না। অগত্যা গিয়ে বসল গাছের ডালে, কিন্তু নজর রাখল পাখিটির দিকে। ওদিকে ছোট্ট পাখিটি দুরু দুরু বুকে গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো শব্দ করছে না; পালানোর পথ খুঁজছে। মিনিট পাঁচেক পর ফিঙে রণে ভঙ্গ দিয়ে উড়ে গেল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পাখিটি। তারপর লাফাতে লাফাতে একটু ঘোরাপথে তার বাসার সামনে চলে গেল। সেখানে অপেক্ষা করছিল সাত দিন বয়সী ক্ষুধার্ত তিনটি ছানা। ছানাদের ঝটপট খাইয়ে বের হয়ে এল; একটু হেঁটে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অল্প উড়ে গিয়ে পাশের মাঠে আবার খাবার খুঁজতে লাগল পাখিটি।
এতক্ষণ যে পাখিটির কথা বললাম, সেটি হচ্ছে নাড়া-আইল-মাঠ-ঘাসবনের একরত্তি পাখি ভরত। তবে মাঠের সবচেয়ে ছোট্ট পাখি নয় এটি। ভরত অ্যালাউডিডি পরিবারভুক্ত। ইংরেজি নাম Rufous-winged বা Bengal Bush Lark; বৈজ্ঞানিক নাম Mirafra assamica. এ দেশের সব জায়গায় আছে। আমাদের সাত প্রজাতির ভরতের পাঁচটি স্থায়ী ও দুটি পরিযায়ী। দেখতে চড়ুই-বাবুইদের মতো; কিছুটা মোটা। লম্বা ১৫ সেন্টিমিটার। মাথার ওপর থেকে পিঠ হয়ে লেজের ওপরটা ধূসর ও তাতে কালচে ডোরা। বুক, পেট ও লেজের গোড়া ধূসর-হলুদ; তাতে লালচে আভা। বুকে বেশ কিছু কালচে দাগ। ডানার দুই পাশ লালচে; লেজের দুই পাশ ও মুখমণ্ডলেও লালচে আভা। মাথায় হালকা ঝুঁটি, ভয় পেলে যা জেগে ওঠে। হালকা হলুদ ঠোঁটের ওপর পোড়ামাটির আভা। পা, আঙুল ও নখও একই রঙের। পুরুষ পাখি ও মহিলা পাখি দেখতে একই রকম। তবে মহিলা পাখিটি পুরুষটির থেকে খানিকটা মোটা ও হালকা রঙের।
ভরত ঘাস ও ঝোপঝাড়পূর্ণ খড়খড়ে মাঠ, ধানের গোড়া আছে এমন কৃষিজমি, খেতের আইল, ছোট ছোট ঝোপ ধরে হাঁটে ও খাবার সংগ্রহ করে। বশেমুরকৃবিতে আমি ও আমার পাখি পর্যবেক্ষণের সঙ্গী কামাল প্রায় এক বছর শ খানেক ভরতের ওপর নজর রাখছি। এরা একাকি, জোড়ায় বা চার-পাঁচটির দলে থাকে। এখানকার একেকটি মাঠে ৪-১৬টি পাখি বাস করছে। এরা পোকামাকড়, ঝরা ধান, ঘাসের বীজ, কচি ঘাসের ডগা খেতে পছন্দ করে। পানি পান করে কম। ঝড় এলে মাটিতে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে।
ভরতের ওড়ার ভঙ্গিমা বৈচিত্র্যপূর্ণ। মাটি থেকে সোজা ওপর দিকে উঠে যায়। তারপর আকাশে অনেকটা সাঁতার কাটার মতো ওড়ে। নামেও সোজাভাবে, তবে শেষদিকে খানিকটা ঘুরে নামে। পুরুষ ভরত সুন্দর ঢঙে গান গায়। এমন সুন্দর গান মাঠের আর কোনো পাখি গায় কি না, সন্দেহ আছে। বাসা তৈরি, ডিম পাড়া ও বাচ্চা হলে পুরুষগুলো আনন্দে আটখানা হয়ে নাচে ও গান গায়। আকাশের ওপরে উঠে ‘চিররা, চিরোরা, চিরোরা’, স্বরে ডাকতে থাকে।
ভরত নিরীহ পাখি; বেশ সাবধানি ও চতুর। এরা বর্ষার আগে, বসন্ত থেকে গরমকালের মধ্যে বাসা বানায়। উলুঘাসের তলা, চওড়া-ঘন আইল বা ঘাসবনের ভেতরটাই বেশি পছন্দ। সরু শুকনো ঘাস, ধানপাতা বা খড় দিয়ে ছোট বাটির মতো বাসা বানায়; মুখটি গোলাকার। সময় লাগে পাঁচ দিন। সাধারণত ডিম পাড়ে তিনটি। ডিমের রং সাদা, ওপরে কালো বা খয়েরি ছোট ছোট ছিট। ডিম ফোটে ১০-১৩ দিনে। আমরা এখন পর্যন্ত আটটি বাসা পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রতিটিতে তিনটি করে ডিম ছিল। মাঠের সাপ, গুইসাপ, বেজি ও শিয়াল ঘোরাঘুরি করলেও সহজে ডিম-বাচ্চার খোঁজ পায় না। কিন্তু রাখাল, ঘুঁটে কুড়ানি ও দুষ্টু ছেলের দল ঠিকই খুঁজে পায় ও ডিম-বাচ্চা নষ্ট করে। সম্ভবত একটি বাসার ডিম দুষ্টু ছেলেরা নিয়ে গিয়েছিল। বাকিগুলোতে তিনটি করে বাচ্চা হয়েছিল। বাচ্চারা বাসা ছাড়ে ১০-১২ দিনে। এ সময় এরা উড়তে পারে না; মা-বাবার পেছন পেছন হেঁটে বেড়ায় ও মুখ হাঁ করে পাখা নাচিয়ে কাঁদতে থাকে। ছানারা ওড়ে ২৪-২৫ দিনে। বিপদের গন্ধ পেলে বাচ্চারা মুহূর্তের মধ্যে মাটির সঙ্গে বা ঘাসের মধ্যে বুক মিশিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ভরত মৌসুমে সাধারণত দুবার বাচ্চা তোলে। বাঁচে ১২-১৫ বছর ।প্রথম আলো
কয়েক দিন আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের (বশেমুরকৃবি) মাঠে হাঁটার সময় দেখি, ছোট্ট একটি পাখি মুখে পোকা নিয়ে নামছে। পাখিটি মাটি থেকে যখন ইঞ্চি ছয়েক ওপরে, ঠিক তখন কোত্থেকে একটি ফিঙে এসে আক্রমণ করল তাকে। উদ্দেশ্য, পোকাটি ছিনিয়ে নেওয়া।
ছোট্ট পাখিটি প্রাণপণে উড়াল দিল, পেছন পেছন ফিঙেও। দু-একটা ঠোকরও বসিয়ে দিল, কিন্তু পোকাটি ছিনিয়ে নিতে পারল না। দাঁড়িয়ে দেখছি সেই চমৎকার দৃশ্য। মিনিট দুই-তিন ধাওয়ার পর হঠাৎ পাখিটি মাটিতে নেমে দৌড়ে পাশের ছোট্ট ঝোপালো গাছের তলায় লুকাল। ফিঙে অনেক চেষ্টা করেও সেখানে ঢুকতে পারল না। অগত্যা গিয়ে বসল গাছের ডালে, কিন্তু নজর রাখল পাখিটির দিকে। ওদিকে ছোট্ট পাখিটি দুরু দুরু বুকে গাছের তলায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনো শব্দ করছে না; পালানোর পথ খুঁজছে। মিনিট পাঁচেক পর ফিঙে রণে ভঙ্গ দিয়ে উড়ে গেল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল পাখিটি। তারপর লাফাতে লাফাতে একটু ঘোরাপথে তার বাসার সামনে চলে গেল। সেখানে অপেক্ষা করছিল সাত দিন বয়সী ক্ষুধার্ত তিনটি ছানা। ছানাদের ঝটপট খাইয়ে বের হয়ে এল; একটু হেঁটে এদিক-ওদিক তাকিয়ে অল্প উড়ে গিয়ে পাশের মাঠে আবার খাবার খুঁজতে লাগল পাখিটি।
এতক্ষণ যে পাখিটির কথা বললাম, সেটি হচ্ছে নাড়া-আইল-মাঠ-ঘাসবনের একরত্তি পাখি ভরত। তবে মাঠের সবচেয়ে ছোট্ট পাখি নয় এটি। ভরত অ্যালাউডিডি পরিবারভুক্ত। ইংরেজি নাম Rufous-winged বা Bengal Bush Lark; বৈজ্ঞানিক নাম Mirafra assamica. এ দেশের সব জায়গায় আছে। আমাদের সাত প্রজাতির ভরতের পাঁচটি স্থায়ী ও দুটি পরিযায়ী। দেখতে চড়ুই-বাবুইদের মতো; কিছুটা মোটা। লম্বা ১৫ সেন্টিমিটার। মাথার ওপর থেকে পিঠ হয়ে লেজের ওপরটা ধূসর ও তাতে কালচে ডোরা। বুক, পেট ও লেজের গোড়া ধূসর-হলুদ; তাতে লালচে আভা। বুকে বেশ কিছু কালচে দাগ। ডানার দুই পাশ লালচে; লেজের দুই পাশ ও মুখমণ্ডলেও লালচে আভা। মাথায় হালকা ঝুঁটি, ভয় পেলে যা জেগে ওঠে। হালকা হলুদ ঠোঁটের ওপর পোড়ামাটির আভা। পা, আঙুল ও নখও একই রঙের। পুরুষ পাখি ও মহিলা পাখি দেখতে একই রকম। তবে মহিলা পাখিটি পুরুষটির থেকে খানিকটা মোটা ও হালকা রঙের।
ভরত ঘাস ও ঝোপঝাড়পূর্ণ খড়খড়ে মাঠ, ধানের গোড়া আছে এমন কৃষিজমি, খেতের আইল, ছোট ছোট ঝোপ ধরে হাঁটে ও খাবার সংগ্রহ করে। বশেমুরকৃবিতে আমি ও আমার পাখি পর্যবেক্ষণের সঙ্গী কামাল প্রায় এক বছর শ খানেক ভরতের ওপর নজর রাখছি। এরা একাকি, জোড়ায় বা চার-পাঁচটির দলে থাকে। এখানকার একেকটি মাঠে ৪-১৬টি পাখি বাস করছে। এরা পোকামাকড়, ঝরা ধান, ঘাসের বীজ, কচি ঘাসের ডগা খেতে পছন্দ করে। পানি পান করে কম। ঝড় এলে মাটিতে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে।
ভরতের ওড়ার ভঙ্গিমা বৈচিত্র্যপূর্ণ। মাটি থেকে সোজা ওপর দিকে উঠে যায়। তারপর আকাশে অনেকটা সাঁতার কাটার মতো ওড়ে। নামেও সোজাভাবে, তবে শেষদিকে খানিকটা ঘুরে নামে। পুরুষ ভরত সুন্দর ঢঙে গান গায়। এমন সুন্দর গান মাঠের আর কোনো পাখি গায় কি না, সন্দেহ আছে। বাসা তৈরি, ডিম পাড়া ও বাচ্চা হলে পুরুষগুলো আনন্দে আটখানা হয়ে নাচে ও গান গায়। আকাশের ওপরে উঠে ‘চিররা, চিরোরা, চিরোরা’, স্বরে ডাকতে থাকে।
ভরত নিরীহ পাখি; বেশ সাবধানি ও চতুর। এরা বর্ষার আগে, বসন্ত থেকে গরমকালের মধ্যে বাসা বানায়। উলুঘাসের তলা, চওড়া-ঘন আইল বা ঘাসবনের ভেতরটাই বেশি পছন্দ। সরু শুকনো ঘাস, ধানপাতা বা খড় দিয়ে ছোট বাটির মতো বাসা বানায়; মুখটি গোলাকার। সময় লাগে পাঁচ দিন। সাধারণত ডিম পাড়ে তিনটি। ডিমের রং সাদা, ওপরে কালো বা খয়েরি ছোট ছোট ছিট। ডিম ফোটে ১০-১৩ দিনে। আমরা এখন পর্যন্ত আটটি বাসা পর্যবেক্ষণ করেছি। প্রতিটিতে তিনটি করে ডিম ছিল। মাঠের সাপ, গুইসাপ, বেজি ও শিয়াল ঘোরাঘুরি করলেও সহজে ডিম-বাচ্চার খোঁজ পায় না। কিন্তু রাখাল, ঘুঁটে কুড়ানি ও দুষ্টু ছেলের দল ঠিকই খুঁজে পায় ও ডিম-বাচ্চা নষ্ট করে। সম্ভবত একটি বাসার ডিম দুষ্টু ছেলেরা নিয়ে গিয়েছিল। বাকিগুলোতে তিনটি করে বাচ্চা হয়েছিল। বাচ্চারা বাসা ছাড়ে ১০-১২ দিনে। এ সময় এরা উড়তে পারে না; মা-বাবার পেছন পেছন হেঁটে বেড়ায় ও মুখ হাঁ করে পাখা নাচিয়ে কাঁদতে থাকে। ছানারা ওড়ে ২৪-২৫ দিনে। বিপদের গন্ধ পেলে বাচ্চারা মুহূর্তের মধ্যে মাটির সঙ্গে বা ঘাসের মধ্যে বুক মিশিয়ে পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ভরত মৌসুমে সাধারণত দুবার বাচ্চা তোলে। বাঁচে ১২-১৫ বছর ।প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment