রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামের একটি আম গাছে বাসা বেঁধেছে অতিথি পাখিরা
ছবি: শহীদুল ইসলাম
এগুলো আসলে অতিথি পাখি। প্রতিবছর শীতে আসে আবার শীতের শেষে চলে যায়। কিন্তু বছর তিনেক ধরে পাখিগুলো রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার কালুহাটি গ্রামেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাসা বাঁধে, ডিম দেয় ও বাচ্চা ফোটায়। এরা সবাই শামুকখোল। গ্রামবাসীও এদের প্রশ্রয় দিয়েছে। পাখি মারা তো দূরের কথা, রীতিমতো ওদের পাহারা দিয়ে রাখে তারা।
চারঘাট উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নিভৃত গ্রাম কালুহাটি। ঘটনা তিন বছর আগের। গ্রামের একটি শিমুলগাছের মগডালে কয়েকটি অতিথি পাখি এসে বসে। কেউ উৎপাত করছে না দেখে পাখিগুলো কিছুদিন পর নিচের ডালগুলোতে নেমে আসে। গ্রামের লোকেরা অবাক হয়ে দেখল, এসব পাখির শীত শেষে চলে যাওয়ার কথা, অথচ ওরা বাসা বাঁধছে। নিরাপদ আশ্রয় পাওয়ায় প্রতিবছরই বাড়ছে পাখির সংখ্যা।
গ্রামের বাড়ি-ডাকরা ডিগ্রি কলেজের ছাত্র লিটন মাহমুদ জানান, প্রথমবার শিমুলগাছের নিচের হালকা একটা ডালে এত বেশি পাখি বাসা বেঁধেছিল যে, ভার সইতে না পেরে ডাল ভেঙে অনেক পাখির বাসা নিচে পড়ে ডিম ভাঙে ও বাচ্চা মরে যায়। এ ঘটনায় গ্রামের লোকেরা বেশ মর্মাহত হয়। এর পর থেকেই পাখিদের জন্য গ্রামবাসীর মনে অন্যরকম একটা মায়া জন্মায়। সবাই পাখিদের প্রতি খেয়াল রাখে।
এখন পাখিগুলো পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তারা বাসা বাঁধার সময় কয়েকটি নির্দিষ্ট গাছ বেছে নিচ্ছে। এবার পাখিগুলো বাসা বাঁধছে গ্রামের স্কুলশিক্ষক আমজাদ হোসেনের দুটি আমগাছে ও রূপচান আলীর কড়ইগাছে।
কালুহাটি গ্রামে একবেলা: গত বৃহস্পতিবার সকালে কালুহাট গ্রামে ঢুকে কাউকে জিজ্ঞেস করতে হয়নি, অতিথি পাখিরা কোথায় থাকে? দূর থেকেই চোখে পড়ে স্কুলশিক্ষক আমজাদ হোসেনের আমগাছাটি পাখিতে পাখিতে সাদা হয়ে আছে। গাছের গা ঘেঁষে রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে বিকট শব্দে ভটভটিসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চলাচল করছে। মোটরসাইকেল ও সাইকেল আরোহীরা কৌতূহলী হয়ে গাছটার কাছে এসে একটু থেমে পাখিদের কাজকর্ম দেখছে। এতে করে গাছটির পাশে সারাক্ষণ মানুষের জটলা লেগেই আছে। কিন্তু পাখিগুলো মানুষকে ভয় পাচ্ছে না মোটেই। ভীষণ ব্যস্ত ওরা নিজের কাজে।
গাছের মালিক আমজাদ হোসেন জানান, আম পেড়ে নেওয়ার পরপরই পাখিরা এসে গাছটিতে বাসা করেছে। তিনি খুবই অবাক হয়েছেন, পাখিরা পাশের অন্য একটি গাছে ছিল। আম পাড়ার আগে তারা আসেনি। এখন পুরো গাছ তাদের দখলে। ডালপালা ভেঙে বাসা করেছে। পরের মৌসুমে গাছে আর আম ধরবে না বলে তাঁর এক আত্মীয় পাখিগুলোকে তাড়িয়ে দিতে বলেছেন। কিন্তু তিনি তাঁর আত্মীয়র কথা শোনেননি। তিনি বলেন, এই পাখি ডাকলেও আসবে না। এত সুন্দর পাখি স্বেচ্ছায় তাঁর গাছে আশ্রয় নিয়েছে। টাকা খরচ করেও এমন সুন্দর একটা পরিবেশ তৈরি করা যাবে না। তা ছাড়া অতিথি পাখি মারা সরকার থেকেই নিষেধ আছে। তাই তিনি সাধ্যমতো পাখিদের দেখাশোনা করছেন, কেউ যেন তাদের বিরক্ত না করে।
গাছটির এমন কোনো ডাল নেই, যেখানে পাখির বাসা নেই। ছোট ডালপালা ভেঙে বাসায় জড়ো করে বাসা তৈরি করেছে। ওদের কাজ দেখে চোখ ফেরানো যায় না। কোনোটা বাচ্চার মুখে খাবার দিচ্ছে। কোনোটা বাসা তৈরির জন্য গাছের ডাল ভাঙছে। ঠোকাঠুকি করছে বা দু-তিনটা মিলে গায়ে গা লাগিয়ে বসে রয়েছে। আবার কোনোটা অন্য গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে আসছে ঠোঁটে করে। বাসায় ধূসর রঙের বাচ্চারা হাঁ করে বসে আছে। ভয়ডর তো নেই, চলাফেরায়ও অবাধ স্বচ্ছন্দ। গ্রামটা যেন তাদেরই।
পাখিদের পাহারায় গ্রামবাসী: গ্রামের মুদি দোকানি তোতা বলেন, ‘প্রথম দিকে অন্য গ্রাম থেকে বন্দুক নিয়ে কয়েকবার পাখি মারতে এসেছে কিছু লোক। আমরা তাদের বের করে দিয়েছি। সবাই জেনে গেছে কালুহাটি গ্রামে বন্দুক নিয়ে কেউ পাখি মারতে গেলে তার বিপদ আছে।’ গ্রামবাসী জানাল, এই পাখি দিনের বেলায় মাঠে চরে বেড়ায়। সেখানেও সবাইকে বলে দেওয়া আছে, কেউ যেন পাখি না মারে। মাঠে যে শ্রমিকেরা কাজ করেন, তাঁরাও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকেন।
তবে গ্রামবাসী পেরে উঠছে না কাকের সঙ্গে। সুযোগ পেলেই কাক এসে শামুকখোলের বাসা থেকে ডিম নিয়ে যাচ্ছে। কাক তাড়াতে গেলে যদি পাখিগুলো ভয় পেয়ে চলে যায়, সে কারণে তারা কাকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
কলকাকলিমুখর পাখির গ্রাম: কালুহাটি গ্রামটি এখন পাখির গ্রাম বলেই পরিচিতি পেয়েছে আশপাশে। সারা রাত এসব পাখির কলকাকলিতে গ্রাম মুখরিত হয়ে থাকে। গ্রামের সুখদা বেগম বলেন, ‘রাতে এই গ্রামে কোনো নতুন মানুষ এলে ভয়ই পাবে। আমাদের দেশি পাখিরা প্রহরে প্রহরে কিচিরমিচির করে, কিন্তু এই পাখির ডাক বেশ অন্য রকম। অনেক দূর থেকেও শোনা যায় সেই ডাক।’
প্রথম আলো
0 comments:
Post a Comment