বাঁশঝাড়ে বাঁশঘুঘু ডিমে তা দিচ্ছে
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ যদিও এদের জন্য কবুতরের খোঁপের মতো বাসা তৈরি করে দিয়েছে, কিন্তু এরা বাঁশঝাড়েই নিজেদের বাসা বানাতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। পাখির তত্ত্বাবধায়ককে খাঁচার সামনেই পেলাম। তাঁর কাছে জানলাম, প্রায় দুই বছর পর বাঁশঘুঘু বাসা বেঁধেছে। খাঁচায় বাঁশঘুঘু আছে পাঁচটি।
কী হলো, খোঁজ নিতে আবার চিড়িয়াখানা গেলাম এপ্রিলের শুরুতে। ভেবেছিলাম, খাঁচায় নিশ্চয় বাঁশঘুঘুর সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গুণে দেখলাম পাঁচটিই রয়েছে। ব্যাপারটা কী? তত্ত্বাবধায়ক বললেন, দর্শনার্থীরা বিরক্ত করায় বাসা তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত ডিম পাড়েনি। মন খারাপ করে চলে এলাম।
তবে খোঁজ রাখলাম নিয়মিতই এবং খবর পেলাম আবার বাসা বেঁধেছে বাঁশঘুঘু। পাখিবিশারদ শরীফ খান খবর দিলেন, চিড়িয়াখানায় এবার বাঁশঘুঘুর ডিম ফুটেছে। ছানা হয়েছে একটি।
এপ্রিলের শেষ নাগাদ গিয়ে দেখতে পেলাম এবার বাঁশঘুুঘুর সংখ্যা ছয়টি। বাবা-মায়ের সঙ্গে বেশ আমোদ-আহ্লাদ করছে ছোট্ট ছানাটি। বেশ ভালো লাগল।
বাঁশঘুঘু এ দেশে ‘সবুজ ঘুঘু’ নামে বেশি পরিচিত। এদের কোথাও কোথাও ‘পাতি শ্যামাঘুঘু’ও বলে। বাঁশবন বা বাঁশঝাড়ে বেশি দেখা যায় বলে এরা বাঁশঘুঘু নামে পরিচিত। ১৯৯৬ সালে বাগেরহাটে এই নামটি শুনেছি। তখন থেকেই নামটি আমার মনে ধরেছে। বাঁশঘুঘুকে ইংরেজিতে Common বা Green emerald dove, Bronze-winged dove বা Green-winged pigeon বলা হয়। বৈজ্ঞানিক নাম Chalcophas indica বা Columba indica. অনেকের মতে, এ দেশের বিভিন্ন প্রজাতির ঘুঘুর মধ্যে বাঁশঘুুঘুই সবচেয়ে সুন্দর।
বাঁশঘুঘু লম্বায় ২৭ সেন্টিমিটার ও ওজন ১৩০ থেকে ১৩৫ গ্রাম। এদের ডানা ও পিঠ সবুজ। পিঠের নিচে দুটো সাদা দাগ; তার মাঝখানে একটি কালো দাগ। পুরুষ পাখি বা পায়রার দেহের ওপরের অংশ চকচকে পান্না সবুজ। মাথা ধূসর, কপাল, থুঁতনি ও ভুরু সাদা। কাঁধের ওপরে ছোট সাদা দাগ। লেজ ও ডানার ওড়ার পালক কালচে। মাথার দুই পাশ ও দেহের নিচের অংশ সুন্দর লালচে বাদামি (বা গোলাপি)। পায়রি দেখতে পায়রার মতো হলেও মাথা, থুঁতনি ও কাঁধের ওপরের অংশ বাদামি। কপাল ও ভুরু ধূসর। পায়রির দেহের নিচের অংশ গাঢ় বাদামি। পায়রা-পায়রি উভয়ের ঠোঁট উজ্জ্বল লাল বা গোলাপি লাল। পা ও নখ গোলাপি। বাচ্চা দেখতে অনেকটা মায়ের মতো হলেও এদের ঠোঁট বাদামি-ধূসর, কপালে দুটো ধূসর দাগ, লেজের দিকটা লালচে-বাদামি, গলা ও দেহের নিচের অংশের পালকের প্রান্ত হলদে।
বাঁশঘুঘু মূলত পাতাঝরা, চিরসবুজ, শাল ও বাঁশবনের বাসিন্দা। সুন্দরবনে প্রচুর আছে। সিলেটের বিভিন্ন বনেও আছে বেশ। একসময় প্রায় সারা দেশেই গ্রামাঞ্চলে দেখা যেত। কিন্তু শিকারিদের কবলে পড়ে এবং বাঁশঝাড় ও ঝোপজঙ্গল কমে যাওয়ায় বর্তমানে তেমন একটা দেখা যায় না। বলা যায় বিপন্ন। তবে বাগেরহাটের গ্রামীণ বনগুলোতে এরা এখনো মোটামুটি আছে। বাঁশঘুঘু একাকী, জোড়ায় বা ছোট দলে থাকে। এরা গাছ বা বাঁশঝাড়ের তলায় হেঁটে হেঁটে শস্যদানা, ফল, বিচি ও উইপোকা খায়। বনের ধারে নির্জন খোলা জায়গায় কিংবা রাস্তার ধারে খুব ভোরে, ভরদুপুরে বা সন্ধ্যার আগে আগে খাবার খেতে নামে। সাধারণত খেতখামারে এদের দেখা যায় না। এরা মানুষকে বেশ ভয় পায় ও এড়িয়ে চলে। বনের ভেতরে খুব কম উচ্চতায়ও বেশ দ্রুতগতিতে উড়তে পারে। এদের গলার স্বর বেশ নরম, ‘হু-হু-হুন’ স্বরে ডাকে। সারা বছর প্রজনন করতে পারলেও সাধারণত বর্ষার আগে ডিম দেয় বেশি। ছোট গাছ, বাঁশঝাড় বা ঝোপঝাড়ে কয়েকটি কাঠিকুটি জড়ো করে ছোট্ট ও অগোছালো বাসা বানায়। পায়রি দুটো হালকা ঘিয়ে বা হলদে রঙের ডিম পাড়ে। ডিম ফোটে ১২ দিনে।
0 comments:
Post a Comment